ইসলামে বলা হয়, নবী-রাসূলগণ সমগ্র মানবজাতির জন্য পাঠানো হয়েছে। কিন্তু যদি আমরা কুরআন ও হাদিসের তথ্যে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই, সমস্ত উল্লেখিত নবী শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরেই সীমাবদ্ধ।
(ক) নবীদের ভৌগোলিক অবস্থান
কুরআনে উল্লেখিত ও হাদিসে বর্ণিত নবীরা সবাই মূলত মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং সেখানেই কাজ করেছেন।
উদাহরণস্বরূপ, আদম, নূহ, ইবরাহিম, মুসা, ঈসা, এবং মুহাম্মদ—এদের সবাই মধ্যপ্রাচ্যের কোনো না কোনো অঞ্চলের বাসিন্দা।
অন্যদিকে, চীন, ভারত, আফ্রিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া বা আমেরিকার মতো বিশাল অঞ্চলগুলোর কোনো নবীর উল্লেখ কুরআনে পাওয়া যায় না।
(খ) ইসলাম যদি সার্বজনীন হতো, তবে নবীরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকতেন
যদি আল্লাহ সত্যিই সমস্ত জাতির প্রতি সমান দৃষ্টি দিতেন, তাহলে কেন তিনি সব মহাদেশে নবী পাঠাননি?
কেন ইসলামিক ইতিহাসে মধ্যপ্রাচ্যের বাইরের কোনো নবীর অস্তিত্ব নেই?
কুরআন দাবি করে যে ইসলাম সকল মানুষের জন্য, কিন্তু বাস্তবে নবীদের অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে বিস্তৃত হয়নি।
(গ) নবীদের সংখ্যা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে অনুপস্থিতি
ইসলামের তথ্যানুসারে ১,২৪,০০০ নবী পাঠানো হয়েছে।
এত বিশাল সংখ্যক নবী থাকার পরও কেন শুধু মধ্যপ্রাচ্যের কিছু নবীই ইতিহাসে টিকে আছে?
কেন চীন, ভারত, আফ্রিকা বা আমেরিকার কোনো নবীর নাম মুসলিম ঐতিহ্যে নেই?
এই বিষয়গুলো দেখায় যে, ইসলামে নবীদের বৈশ্বিক বিতরণ নেই বরং এটি মধ্যপ্রাচ্যের এক আঞ্চলিক ধর্মের মতো আচরণ করে।
২. কুরআনের দাবি বনাম বাস্তবতা
কুরআনে বলা হয়েছে, "আমি প্রত্যেক জাতির নিকট নবী পাঠিয়েছি।" (সূরা নাহল ১৬:৩৬)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ পৃথিবীর প্রতিটি জাতির জন্য নবী পাঠিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা কেবল মধ্যপ্রাচ্যের নবীদের কথাই পাই, অন্য অঞ্চলের কোনো নবীর তথ্য ইসলামে নেই।
(ক) যদি প্রত্যেক জাতির কাছে নবী পাঠানো হতো, তাহলে কোথায় তাদের প্রমাণ?
পৃথিবীর বড় বড় সভ্যতাগুলোর (চীন, ভারত, গ্রিক, রোমান, মায়ান, ইনকা, জুলু) কোথাও কোনো ইসলাম-সমর্থিত নবীর অস্তিত্ব নেই।
যদি আল্লাহ সত্যিই তাদের কাছে নবী পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে তাদের ধর্মগ্রন্থ, সংস্কৃতি বা ইতিহাসে তার কোনো চিহ্ন থাকার কথা।
কিন্তু আমরা দেখি, এই জাতিগুলোর ধর্ম ইসলামিক নবীদের চেয়ে একদম আলাদা।
(খ) ইসলামিক ঐতিহ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বাইরের নবীদের অনুপস্থিতি
কুরআন বা হাদিসে আফ্রিকা, ইউরোপ, চীন, ভারত, বা আমেরিকার কোনো নবীর নাম উল্লেখ নেই।
মুহাম্মদই শেষ নবী বলে দাবি করা হয়, কিন্তু তিনি ভারত, চীন বা ইউরোপের মানুষদের কিছুই জানাতে পারেননি।
তাহলে কি আল্লাহ কেবল মধ্যপ্রাচ্যের জন্যই নবী পাঠিয়েছেন?
(গ) কুরআনের দাবি কি মিথ্যা?
কুরআন বলে "প্রত্যেক জাতির কাছে নবী পাঠানো হয়েছে", কিন্তু বাস্তবে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নবীদের কথাই বলা হয়েছে।
যদি সত্যিই সব জাতির কাছে নবী পাঠানো হতো, তাহলে কুরআনে অন্তত তাদের নাম বা কাহিনি পাওয়া যেত।
এ থেকে বোঝা যায়, কুরআনের এই দাবিটি বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না এবং এটি মিথ্যা হতে পারে।
এই যুক্তিগুলো প্রমাণ করে যে, কুরআনের দাবি এবং বাস্তব সত্য এক নয়।
৩. অন্য সংস্কৃতির ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের নবী হিসেবে স্বীকৃতি নেই
ইসলামের দাবি অনুযায়ী, প্রত্যেক জাতির জন্য নবী পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, ইসলাম শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের নবীদের স্বীকৃতি দেয়, অন্য সভ্যতার ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের নবী বলে স্বীকার করে না।
(ক) চীন, ভারত ও গ্রীসের মহান ধর্মগুরুদের নবী না বলা
চীনের কনফুসিয়াস, ভারতের কৃষ্ণ ও বুদ্ধ, গ্রীসের সক্রেটিস—এরা সবাই নৈতিকতা, জ্ঞান ও দর্শনের ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রেখেছেন।
কিন্তু ইসলাম তাদের নবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না।
অথচ, যদি আল্লাহ প্রত্যেক জাতির কাছে নবী পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে এদের নবী হিসেবে মেনে নেওয়া উচিত ছিল।
(খ) নবীদের তালিকা কেন কেবল মধ্যপ্রাচ্যের?
ইসলামের নবীদের তালিকা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত।
যদি সত্যিই পৃথিবীর প্রতিটি জাতির জন্য নবী আসতেন, তাহলে কুরআনে কিছু অন্তত ভারত, চীন বা আমেরিকার নবীদের কথা উল্লেখ থাকত।
কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখি, কুরআন বা হাদিসে তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই।
(গ) ইসলাম কেন মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে নবীদের স্বীকার করে না?
মুসলিমরা বলে, হয়তো এই নবীদের বার্তা হারিয়ে গেছে বা বিকৃত হয়েছে।
কিন্তু যদি আল্লাহ সত্যিই চান যে মানুষ সঠিক পথ পায়, তাহলে তিনি কেন তাদের বার্তা সংরক্ষণ করেননি?
অথচ কুরআন দাবি করে, আল্লাহ কুরআন সংরক্ষণ করবেন (সূরা আল-হিজর ১৫:৯)। তাহলে অন্য নবীদের বার্তা কেন রক্ষা করা হলো না?
এই পয়েন্টগুলো দেখায়, ইসলাম যে বলে "প্রত্যেক জাতির কাছে নবী পাঠানো হয়েছে," তা বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। যদি আল্লাহ সত্যিই সব জাতির কাছে নবী পাঠাতেন, তাহলে কনফুসিয়াস, কৃষ্ণ, বুদ্ধ বা জরথুস্ত্রদেরও নবী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হতো।
৪. মুসলিমদের উত্তর ও তাদের সমস্যা
যখন প্রশ্ন ওঠে, “সব নবী কেন শুধু মধ্যপ্রাচ্যে?” তখন মুসলিমরা সাধারণত কয়েকটি যুক্তি দেন। তবে এই উত্তরগুলোর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এগুলো মূল সমস্যার সমাধান করতে পারে না বরং আরও অসংগতি তৈরি করে।
(ক) মুসলিমদের প্রথম উত্তর: ‘অন্য নবীদের নাম হারিয়ে গেছে’
মুসলিমরা বলে, হয়তো চীন, ভারত, ইউরোপ বা আমেরিকায় নবী এসেছিলেন, কিন্তু তাদের নাম ও বার্তা হারিয়ে গেছে।
প্রশ্ন হলো, কুরআনে যদি পূর্ববর্তী নবীদের উল্লেখ থাকে, তাহলে কেন অন্য মহাদেশের নবীদের কোনো নামও উল্লেখ নেই?
যদি তারা নবী হতেন, তাহলে কুরআন বা হাদিসে অন্তত তাদের কিছু তথ্য থাকত।
(খ) ‘তাদের বার্তা বিকৃত হয়ে গেছে’ যুক্তি
মুসলিমরা বলে, আল্লাহ নবী পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু মানুষেরা তাদের বার্তা বিকৃত করেছে।
যদি এটা সত্য হতো, তাহলে কুরআনেই বলা উচিত ছিল, "বুদ্ধ, কনফুসিয়াস বা কৃষ্ণও আমার নবী ছিলেন, কিন্তু তাদের বার্তা পরিবর্তন করা হয়েছে।"
কিন্তু কুরআন এমন কিছুই বলে না। বরং এতে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নবীদের কথাই বলা হয়েছে।
(গ) ‘নবীদের পাঠানোর দরকার হয়নি’ যুক্তি
কেউ কেউ বলে, হয়তো ওইসব অঞ্চলে মানুষ সত্যের এত কাছাকাছি ছিল যে নবীর দরকার হয়নি।
কিন্তু এটা কুরআনের "প্রত্যেক জাতির জন্য নবী" (১৬:৩৬) দাবির সম্পূর্ণ বিপরীত।
যদি সত্যিই প্রত্যেক জাতির জন্য নবী পাঠানো হয়, তাহলে এই যুক্তি নিজের সাথেই বিরোধপূর্ণ।
মুসলিমদের দেওয়া এই যুক্তিগুলো কুরআনের দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায় না। তারা যেভাবেই ব্যাখ্যা করুক, শেষ পর্যন্ত এটি প্রমাণিত হয় যে, নবীদের অবস্থান শুধু মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, যা কুরআনের সার্বজনীন নবুয়তের দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করে।
৫. আল্লাহ কি শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ঈশ্বর?
যদি আল্লাহ সত্যিই গোটা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও পরিচালনাকারী হতেন, তাহলে তার কার্যক্রমও বৈশ্বিক হওয়ার কথা। কিন্তু ইসলামের নবুয়ত ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আল্লাহর কর্মকাণ্ড কেবল মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যা তাকে সার্বজনীন ঈশ্বরের পরিবর্তে একটি আঞ্চলিক ঈশ্বর হিসেবে প্রতিস্থাপন করে।
(ক) নবী কেবল মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর কারণ কী?
যদি আল্লাহ সত্যিই সমগ্র পৃথিবীর মানুষকে পথ দেখাতে চান, তাহলে তিনি কেন শুধু মধ্যপ্রাচ্যকেই নবী পাঠানোর জন্য বেছে নিলেন?
চীন, ভারত, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকার মতো বিশাল অঞ্চলগুলোর মানুষ কি পথনির্দেশ পাওয়ার যোগ্য ছিল না?
ইসলামিক ব্যাখ্যায় এর কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দেওয়া হয় না।
(খ) কুরআনের ভাষা ও সংস্কৃতি শুধুই মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক
কুরআনের ভাষা শুধুমাত্র আরবি, যা মূলত মধ্যপ্রাচ্যের লোকদের জন্যই উপযুক্ত।
এতে কেবল আরবদের ঐতিহ্য, রীতিনীতি, এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
যদি এটি বিশ্বজনীন ধর্ম হতো, তাহলে এতে বৈচিত্র্যময় জাতিগুলোর সংস্কৃতি ও সমস্যার সমাধান দেওয়া হতো।
(গ) ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা
কাবা, হজ, কিবলা, রমজান—সবকিছুই আরব কেন্দ্রিক।
যদি ইসলাম সত্যিই সার্বজনীন ধর্ম হতো, তাহলে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলগুলোর ধর্মীয় গুরুত্ব থাকা উচিত ছিল।
কিন্তু পুরো ইসলাম ধর্মটাই কেবল মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
সব নবী শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যে আসা, কুরআনের ভাষা আরবি হওয়া, এবং ইসলামের প্রতিটি রীতিনীতির মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিকতা প্রমাণ করে যে, আল্লাহ আসলে শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের ঈশ্বর। তিনি যদি সত্যিই সার্বজনীন হতেন, তাহলে তার কার্যক্রম, বার্তা ও নবুয়ত পুরো বিশ্বের জন্য ছড়িয়ে পড়ত।
উপসংহার
ইসলাম দাবি করে যে, আল্লাহ সমগ্র বিশ্বের ঈশ্বর এবং তিনি প্রত্যেক জাতির কাছে নবী পাঠিয়েছেন। কিন্তু বাস্তব বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই দাবি বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না।
(১) নবীরা কেন কেবল মধ্যপ্রাচ্যে?
ইসলাম যাদের নবী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তারা সবাই মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ।
পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের কোনো নবীর কথা কুরআনে উল্লেখ নেই।
তাহলে "আমি প্রত্যেক জাতির কাছে নবী পাঠিয়েছি" (১৬:৩৬) এই দাবিটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
(২) কুরআনের বক্তব্য বনাম বাস্তবতা
কুরআন দাবি করে নবীদের বার্তা বিকৃত হয়ে গেছে, কিন্তু যদি সত্যিই পৃথিবীর প্রত্যেক অঞ্চলে নবী আসতেন, তাহলে তাদের কিছু না কিছু ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে যেত।
বাস্তবতা হলো, চীন, ভারত, আমেরিকা বা ইউরোপের সভ্যতাগুলোতে ইসলামের কোনো স্বীকৃত নবীর অস্তিত্ব দেখা যায় না।
(৩) আল্লাহ কি শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ঈশ্বর?
ইসলাম ধর্মের যাবতীয় বিধি-বিধান মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক।
ইসলামের মূল অনুসঙ্গ—কাবা, হজ, কুরআন, রমজান, নবী—all are Arab-centered.
এসব প্রমাণ করে, ইসলাম আদতে আরবদের আঞ্চলিক ধর্ম, যা পরে বিশ্বজনীন করার চেষ্টা করা হয়েছে।
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
যদি সত্যিই আল্লাহ সার্বজনীন হতেন, তাহলে তিনি কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতেন না। তার নবীরা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে থাকতেন, এবং কুরআনের ভাষা, সংস্কৃতি, বার্তা সব মানুষের জন্য উপযোগী হতো। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। তাই কুরআনের "প্রত্যেক জাতির জন্য নবী" পাঠানোর দাবি মিথ্যা এবং আল্লাহ আদতে মধ্যপ্রাচ্যেরই এক আঞ্চলিক দেবতা ছিলেন।